বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বাণিজ্যিক ছবির অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা-প্রযোজক-মারপিট পরিচালক ও মুক্তিযোদ্ধা জসিম-এর ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৮ বছর। অকাল প্রয়াত অভিনেতা জসিম-এর স্মৃতির প্রতি জানাই বিন্ম্র শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
অভিনেতা জসিম (আবুল খায়ের জসিম উদ্দিন) ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট, ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বক্সনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। তিনি লেখাপড়া করেন বিএ পর্যন্ত।
১৯৭১-এ যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন জসিম ছিলেন কলেজ ছাত্র। বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দুই নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জসিম।
আজিম পরিচালিত ‘দেবর’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রের আসেন জসিম। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশের প্রথম অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র ‘রংবাজ’-এ অ্যাকশন ডিরেক্টর হিসেবে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করেন তিনি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অ্যাকশনের পথপ্রদর্শক হিসেবে কিংবদন্তী হয়ে আছেন জসিম।
মারপিট পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে আসা জসিম, শুরুর দিকে ছোট-খাটো দৃশ্যে অভিনয় করতেন। পরবর্তীতে দেওয়ান নজরুল পরিচালিত ‘দোস্ত দুশমন’ চলচ্চিত্রে প্রধান খলনায়কের ভুমিকায় অভিনয় করে ব্যাপক পরিচিতি পান। ‘দোস্ত দুশমন’ ছবিটি সাড়াজাগানো হিন্দি চলচ্চিত্র ‘শোলে’র পুন:র্নিমাণ। ছবিটিতে তিনি ‘গাফফার’ চরিত্রে অভিনয় করে, প্রশংসিত হন এবং ভিলেন হিসেবে হয়ে ওঠেন জনপ্রিয়।
খলচরিত্রের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করলেও পরবর্তীকালে নায়ক হিসেবেও জসিম সফলতা পেয়েছিলেন। নায়ক হিসেবে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওমর শরীফ’ । দেলোয়ার জাহান ঝন্টু পরিচালিত ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত, এই ছবিতে তিনি নায়ক হিসেবে দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। সেই থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছিলেন বাণিজ্যিক ছবির সফল চিত্রনায়ক।
জসিম অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো- এক মুঠো ভাত, কাজল রেখা, নিশান, দোস্ত দুশমন, রাজদুলারী, আসামী হাজির, মহেশখালীর বাঁকে, নাগ নাগিনী, বিজয়িনী সোনাভান, সুন্দরী, প্রতিজ্ঞা, মোকাবেলা, কসাই, নবাবজাদী, বাঁধনহারা, ওস্তাদ সাগরেদ, সবুজ সাথী, লাইলী মজনু, ঘরের বউ, জনি, নাজমা, অভিযান, জিদ্দি, আক্রোশ, অশান্তি, নিষ্পাপ, রকি, হিরো, লালৃু মাস্তান, সারেন্ডার, সুখ শান্তি, আদিল, ভাইজান, ছোট বউ, ধনরত্ন, কাজের বেটি রহিমা, ন্যায় অন্যায়, লক্ষ্মীর সংসার, ধর্ম আমার মা, মাস্তান রাজা, শান্তি অশান্তি, হিংসা, নাগ নাগিনীর প্রেম, আশিক প্রিয়া, কালিয়া, তুফান, জবাব, মান-সম্মান, মহল, বদলা, বারুদ, কুরবানী, বাংলার নায়ক, পরিবার, রাজা বাবু, বুকের ধন, লাল গোলাপ, দাগী, টাইগার, হাবিলদার, ঘাত প্রতিঘাত, গরীবের সংসার, গরীবের ওস্তাদ, নিষ্ঠুর, স্বামী কেন আসামী, ফাইভ রাইফেলস, ভালবাসার ঘর, মেয়েরাও মানুষ প্রভৃতি।
ব্যক্তিজীবনে জসিম প্রথম বিয়ে করে ছিলেন ড্রিমগার্লখ্যাত নায়িকা সুচরিতাকে। পরে তিনি ঢাকার প্রথম সবাক ছবির নায়িকা পূর্ণিমা সেনগুপ্তার মেয়ে, নায়িকা নাসরিনকে বিয়ে করেন। জসিম ও নাসরিন দম্পতির তিন ছেলে। রাতুল, রাহুল ও সামি।
অসাধারণ মেধাবী-প্রতিভাবান অভিনেতা ছিলেন জসিম। সাধারণ এক্সট্রা ভিলেন/খলনায়ক থেকে জাঁদরেল ভিলেন/খলনায়ক। অতঃপর জাঁদরেল ভিলেন/খলনায়ক থেকে জনপ্রিয় নায়ক/ অ্যাকশন কিং হিরো। অভিনয়ের এমন কঠিন সমীকরণ পেরিয়ে একসময় সাধারণ সিনেমা দর্শকদের প্রাণপ্রিয় নায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন জসিম। নিজেকে রাফ অ্যান্ড টাফ হিরোর ইমেজে গড়ে তুলে ছিলেন। চলচ্চিত্রে ধুন্ধুমার অ্যাকশন দেখিয়ে, নিজের অভিনীত সব ছবিকে হিট-সুপারহিট পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অ্যাকশন এবং আধুনিক অ্যাকশনের প্রবর্তক/জনক তিনি। সামাজিক অ্যাকশন ধারার চলচ্চিত্রকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য এক উচ্চতায়। জসিম তাঁর বন্ধু ও সহযোদ্ধা আমান, মাহবুব খানদের নিয়ে জ্যাম্বস ফাইটিং গ্রুপ গড়ে তুলেন। যারা সেই মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তিকে জয় করে দারুণ সব অ্যাকশন দৃশ্য পর্দায় শুধু যুক্ত করেন-নি, অসংখ্য ব্যবসা সফল সুপারহিট অ্যাকশন ছবি নির্মাণ করে, সফল প্রোডাকশন হাউস হিসেবেও পরিচিতি লাভ করে, তাদের ‘জ্যাম্বস’ প্রোডাকশন হাউস ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, সফল চলচ্চিত্র অভিনেতা জসিম। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তাঁর অবদান অবশ্যই স্মরণযোগ্য।