দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষকদের পরিচালিত কোভিড-১৯ টিকা নিয়ে একটি সমীক্ষা সাম্প্রতিক দিনগুলোতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। এই টিকার সাথে ছয় ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকির একটি কার্যকরী প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ব্যাপকভাবে ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
কে এই দাবি করেছেন ?
সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলোতে ‘কোভিড-১৯ টিকাকরণের সাথে যুক্ত ক্যান্সারের ঝুঁকি: দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি বড় জনসংখ্যা-ভিত্তিক সমীক্ষা’ শিরোনামের একটি সমীক্ষা উদ্ধৃত করা হয়েছে। ‘বায়োমার্কার রিসার্চ’ নামের একটি ওপেন অ্যাক্সেস অ্যাকাডেমিক জার্নালে এটি প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাটিতে দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্য বীমা ডেটাবেসের তথ্য ব্যবহার করা হয় এবং একটি প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যায় যে, যারা কোভিড-১৯ টিকা গ্রহণ করেছেন, তাদের মধ্যে এক বছরের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে, এই পরিসংখ্যানগত তথ্যকে দ্রুতই সরাসরি ঝুঁকির চূড়ান্ত ‘প্রমাণ’ হিসেবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। জনমনে ভীতি তৈরি করতে ক্রমেই ভুল তথ্য ছড়াতে শুরু করেন বেশ কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার। ভিজিল্যান্ট ফক্স নামের একটি প্ল্যাটফর্ম, যা নিজেদেরকে ‘স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞ থেকে স্বাধীন সাংবাদিক’ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম সংস্থা হিসেবে দাবি করে, এই গবেষণাটিকে প্রচার করেছে। তারা দাবি করে, গবেষণাটিতে ক্যানসারের সামগ্রিক ঝুঁকি ২৭ শতাংশ বৃদ্ধির বিষয়টি দেখানো হয়েছে। এছাড়াও, ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি ৫৩ শতাংশ এবং প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি ৬৯ শতাংশ বৃদ্ধির মতো অতিরঞ্জিত সংখ্যাও উল্লেখ করা হয়েছে। এই ভুল তথ্য প্রচারে যোগ দিয়েছেন নিকোলাস হালসার, যিনি নিজেকে একজন মহামারি বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে মিথ্যা দাবি করেছেন যে, কোভিড ভ্যাকসিন সাত ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। এই গবেষণাটিকে অন্যান্য গবেষণার সঙ্গে অযাচিতভাবে যুক্ত করে তিনি বলেন, এই ক্যানসারগুলো টিকা নেয়ার পর উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। পিটার এ ম্যাককালোগ, যিনি একজন এমডি ও পিএইচডি এবং যার এই সংক্রান্ত একটি টুইট অর্ধ মিলিয়নেরও বেশিবার দেখা হয়েছে এবং কার্ডিওলজিস্ট ও অ্যাক্টিভিস্ট ডা. অসীম মালহোত্রা—উভয়ই এই দাবিগুলোকে আরও জোরালো করেছেন। মালহোত্রা দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষণাটিকে ‘গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্বেগজনক’ আখ্যা দিয়েছেন।
ভুলটা কোথায় ?
আল জাজিরার ফ্যাক্ট-চেকিং এজেন্সি, সানাদ, মূল অধ্যয়নটি পরীক্ষা করেছে এবং আবিষ্কার করেছে যে এই ভুল তথ্যের প্রচারকারীরা তাদের উদ্ধৃত অংশগুলো থেকে একটি মূল বাক্যাংশ বাদ দিচ্ছেন:’কার্যকারণ সম্পর্ক ছাড়াই মহামারি সংক্রান্ত সংযোগ’ (epidemiological association without causal relationship)। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় একটি ‘মহামারি সংক্রান্ত সংযোগ’ দুটি ঘটনার মধ্যে একটি পরিসংখ্যানগত সম্পর্ক বা সাধারণ প্যাটার্ন নির্দেশ করে, তবে এর মানে এই নয় যে একটি অন্যটির কারণ। যেমন, গ্রীষ্মকালে যদি আইসক্রিম বিক্রি বাড়ে এবং একই সময়ে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনাও বাড়ে, তাহলে এখানে একটি মহামারি সংক্রান্ত সম্পর্ক আছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে আইসক্রিম খেলে মানুষ ডুবে মারা যায়। প্রকৃত ব্যাখ্যাটি সম্ভবত ‘সার্ভিল্যান্স বায়াস’ নামক একটি ঘটনার মধ্যে নিহিত। যারা টিকা নিতে বেশি আগ্রহী ছিলেন, তারা প্রায়শই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং স্ক্রিনিংয়ে বেশি সজাগ ছিলেন। এর ফলে ক্যানসার আগে ধরা পড়েছে, টিকার কারণে নয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষণায় আসলে কী বলা হয়েছে ?
প্রচলিত দাবির বিপরীতে, কোরিয়ান গবেষকরা তাদের সিদ্ধান্তের সীমাবদ্ধতার ওপর জোর দিয়েছেন এবং কার্যকারণ সম্পর্ক প্রমাণের কোনো তথ্য দেয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।গবেষণাপত্রের উপসংহারে লেখকরা উল্লেখ করেছেন, ‘বাস্তব-জগতের ডেটার সীমিত প্রাপ্যতার কারণে, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে আমাদের জনসংখ্যা-ভিত্তিক কোহর্ট গবেষণা ক্যানসারের ক্রমবর্ধমান ঘটনা এবং কোভিড-১৯ টিকার মধ্যে মহামারি সংক্রান্ত সংযোগের পরামর্শ দিয়েছে, যা লিঙ্গ, বয়স এবং টিকার প্রকারভেদে ভিন্ন। তবে, কোভিড-১৯ টিকা-প্ররোচিত হাইপারইনফ্লেমেশনের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্তর্নিহিত আণবিক প্রক্রিয়াগুলোসহ সম্ভাব্য কার্যকারণ সম্পর্ক স্পষ্ট করতে আরও গবেষণার প্রয়োজন।’
কোভিড-১৯ টিকার সঙ্গে ক্যানসারের যোগসূত্র নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি গবেষণাকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তার বাইরেও বিশ্বব্যাপী চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও বৈজ্ঞানিক কর্তৃপক্ষগুলো দ্ব্যর্থহীনভাবে টিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে এবং ক্যানসারের সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র অস্বীকার করেছে। বিএমজে নামের চিকিৎসা বিষয়ক জার্নালের বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, এমআরএনএ ভ্যাকসিনের সঙ্গে ক্যানসারের যোগসূত্রের দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।
গ্লোবাল ভ্যাকসিন ডেটা নেটওয়ার্ক (জিভিডএন) ভ্যাকসিন দ্বারা সৃষ্ট ‘ক্যানসার মহামারি’র ধারণাটিকে একটি ‘মিথ’ বা ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, যা জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের পরিপন্থী। জিভিডএন জোর দিয়ে বলেছে যে, এমআরএনএ ভ্যাকসিন ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য জৈবিক প্রক্রিয়া নেই। কারণ, এই ভ্যাকসিনগুলোতে কোনো জীবন্ত ভাইরাস থাকে না এবং এগুলো কোষের নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করে না।