ইহা যেন ঈশপের গল্পের মতোই। সিংহ খাইবে হরিণশাবককে। তাহারা একই নদীর তীরে দাঁড়াইয়া জল পান করিতেছিল। সিংহ হুংকার ছাড়িল, ‘রে পুচকে, এত বড় সাহস! আমার পানি ঘোলা করিতেছিস?’ হরিণশাবক ভাটিতে দাঁড়াইয়াছিল। পানি ঘোলা করিবার সুযোগ তাহার নাই। কিন্তু হরিণশাবককে ধরিতে সিংহের তো একটি অজুহাত চাই। এই সিংহের মতো রাজধানীতে একধরনের গ্যাঞ্জাম পার্টি রহিয়াছে, যাহারা ‘ধাক্কা দিলি ক্যান?’ বলিয়া ঝগড়া বাধাইয়া ছিনতাই করিতেছে নিরীহ পথচারীদের নিকট হইতে।
ইত্তেফাকে প্রকাশিত এই সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, গ্যাঞ্জাম পার্টির হোতা গ্রেফতারকৃত রাজুর ৮-১০ জনের একটি দল রহিয়াছে। তাহারা রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আড্ডা দিয়া থাকে। অতঃপর কোনো পথচারীকে একা পাইলে তাহার সঙ্গে গ্যাঞ্জাম পার্টির একজন পরিকল্পিতভাবে ধাক্কা খায়। তাহার পর বলে, ‘এই, আমারে ধাক্কা দিলি ক্যান?’ শুরু হইয়া যায় ঝগড়া। এই সময় বাকিরাও আশপাশ হইতে আসিয়া পথচারী সাজিয়া দলের সদস্যের পক্ষ নেয় এবং শিকারি ব্যক্তিকে মারধর শুরু করে। ইহার পর ঐ একলা পথচারীর নিকট হইতে টাকাপয়সা, মোবাইল ফোন হাতাইয়া লইয়া পালাইয়া যায়। কোনো গাড়িচালককে একা দেখিলেও গ্যাঞ্জাম পার্টির একজন ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খাইয়া ‘আমাকে ধাক্কা দিলি ক্যান’ বলিয়া ঝগড়া লাগাইয়া দেয়। অতঃপর একই কায়দায় তাহার নিকট হইতে ছিনতাই করে।
মানবসভ্যতা ও মানবসমাজের কিছু শৃঙ্খলাবদ্ধ ধাপ রহিয়াছে। ইহা অনেকটা বাস্তুতন্ত্রের মতো। বাস্তুতন্ত্রের কোনো একটি উপাত্ত নষ্ট হইলে যেমন পুরা বাস্তুব্যবস্থা ভারসাম্যহীন হইয়া পড়ে, মানবসমাজেরও নিয়ম-শৃঙ্খলার বিশেষ কিছু ধাপ বা ব্যবস্থা নষ্ট হইয়া গেলে পুরা ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। গ্যাঞ্জাম পার্টি, মলম পার্টি, ছ্যাপ পার্টি (নিজের গায়ে নিজেই থুতু ফেলিয়া নিরীহ ব্যক্তিকে বলে—থুতু দিলি ক্যান?) কয়েক দশক আগেও ছিল, এখনো আছে এবং ইহাদের পরিমাণ ও দৌরাত্ম্য সময়ে সময়ে বৃদ্ধি পাইয়া থাকে।
সত্যিকার অর্থে এই ধরনের গ্যাঞ্জাম পার্টি কোথায় নাই? সমাজের নানান ক্ষেত্রে কিছু মানুষের কাজই হইল গ্যাঞ্জাম করা। এবং এই গ্যাঞ্জাম করা হয় পরিকল্পিতভাবে। আর আমরা যেই সকল গ্যাঞ্জাম পার্টির খবর পত্রিকার পাতায় দেখিতে পাই, তাহারা সমস্যা নহে, বরং তাহারা হইল সামাজিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার উপসর্গ। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে কেন গ্যাঞ্জাম পার্টিতে নাম লেখাইয়া অর্থ উপার্জন করিতে হইবে?
তরুণ সমাজে যাহার যেইটুকু যোগ্যতা রহিয়াছে, তাহারা সেই যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাইবে না কেন? আমরা কত শতাংশ তরুণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করিতে পারিয়াছি? প্রতি বত্সর কত বেশি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করিতে পারিয়াছি? আমরা সকলেই জানি, একটি ভালো সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হইয়া থাকে দেশটির কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং নূতন নূতন কর্মসংস্থান সৃষ্টির। স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য নাগরিক সেবা উন্নত করা। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে এই আলোর পরিবর্তে আলেয়া দেখা যায়।
এই জন্য তৃতীয় বিশ্বের মতো দেশগুলির সাধারণ মানুষের একটিই স্বপ্ন—‘ভাত-কাপড়ে’ একটু দুশ্চিন্তামুক্ত হইয়া জীবন যাপন করা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষ ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি মুদ্রাস্ফীতি এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বাঁচিয়া থাকিবার জন্য তাহাদের দৈনন্দিন চাহিদা মিটাইতে হিমশিম খাইতেছে। একদিকে করোনার দীর্ঘ ধকল এখনো শেষ হয় নাই, তাহার সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করিয়া তুলিয়াছে। দেশে দেশে বাড়িতেছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যাপার। এই ব্যাপারে ১৯৮১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান বলিয়াছিলেন সেই বিখ্যাত উক্তি—‘মূল্যস্ফীতি হইতেছে ছিনতাইকারীর মতো হিংস্র, সশস্ত্র ডাকাতের মতো ভয়ংকর এবং খুনির মতোই প্রাণঘাতী।’ সারা বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ, বিশেষ করিয়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি এখন ‘মূল্যস্ফীতি’ নামক হিংস্র ছিনতাইকারী, সশস্ত্র ডাকাত-খুনির কবলে পড়িয়াছে।