English

38 C
Dhaka
মঙ্গলবার, এপ্রিল ২৩, ২০২৪
- Advertisement -

চট্টগ্রামে করোনা সংকটে লাশ দাফন ও সৎকারে আত্মোৎসর্গ গাউসিয়া কমিটির নেতাকর্মীদের

- Advertisements -
Advertisements
Advertisements

করোনা আক্রান্ত মৃতদের সৎকারে যখন স্বজনদের পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন সৎকার করতে এগিয়ে আসে চট্টগ্রামের আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠিত গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তারের ঝুঁকি বাংলাদেশে কমিয়ে আনতে গাউসিয়া কমিটি সকল সহযোগী সংগঠনের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি, সুরক্ষা উপকরণ বিতরণ ও সামর্থ্যহীন মানুষদের সার্বিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। তারই আলোকে করোনায় মৃত ব্যক্তিদের লাশ দাফনে গণমানুষের সেবায় আত্মোৎসর্গ করছেন গাউসিয়া কমিটির নেতাকর্মীরা।
করোনা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সংগঠনটি চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ১৩ জন হিন্দু, ২ জন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষসহ ১০২৫ টি লাশ দাফন ও সৎকার করে। সবচেয়ে বেশি ৭৮৬ জনের লাশ দাফন করা হয় চট্টগ্রামে। এ ছাড়া ঢাকা, সিলেটসহ দেশের কয়েকটি জেলায়ও লাশ দাফন ও সৎকার কাজ করেছেন সংগঠনটির কর্মীরা। লাশ দাফন ছাড়াও বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় অক্সিজেন সিলিন্ডার বিতরণ করাসহ সামর্থ্যহীন এক লক্ষাধিক পরিবারে ত্রাণ বিতরণও করেছেন।
১৯৮৬ সালে চট্টগ্রামের আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.) এই গাউসিয়া কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের তত্ত্বাবধানে দেশে ২০০ এর বেশি মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। সারা দেশে এই সংগঠন সামাজিক ও ধর্মীয় কাজ করে যাচ্ছেন। দেশের ৫০ জেলায় রয়েছে তাঁদের সংগঠনের বিস্তার। উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে এই সংগঠনের প্রায় ৩ হাজার কর্মী করোনায় মৃতদের দাফনে কাজ করছেন।

২০ জুলাই নগরের একটি হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান, বাঁশখালী উপজেলার শীলকূপ টাইম বাজার দাশপাড়ার বাসিন্দা অমেন্দ্র বিকাশ দাশ। মৃতের নিকটাত্মীয়ের অনুরোধে গাউসিয়া কমিটির স্বেচ্ছাসেবক টিম নিজস্ব অ্যাম্বুল্যান্সে মরদেহ বাঁশখালীতে নিয়ে তাদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শেষ কৃত্যে সনাতন ধর্মের পুরোহিত ও মৃতের নিকটাত্মীয়দের সৎকারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে।
১১ জুন করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান রাঙ্গুনিয়ার সুব্রত বিকাশ বড়ুয়া (৬৭) নামের এক বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা। পরিবারের অনুরোধে লাশ অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানো, গোসল দেওয়া থেকে শুরু করে শেষকৃত্যের সব কাজ করেন গাউসিয়া কমিটির রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া কমিটির কর্মীরা।
২৯ মে জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্টসহ করোনার উপসর্গ নিয়ে নগরের বাসায় মারা যান রাউজানের বাসিন্দা মুহাম্মদ নাসির (৪৫)। গভীর রাতে ছোট্ট দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ গ্রামে নিয়ে যায় স্ত্রী। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনে স্বজন, প্রতিবেশী ও স্থানীয়রা কেউ বের হননি। জানাজা পড়ানোর ভয়ে মসজিদের ইমামও পালিয়ে যান। খবর পেয়ে লাশ দাফনে ছুটে আসেন গাউসিয়া কমিটির স্বেচ্ছাসেবকরা। তাঁরা লাশ গোসলের পর কাফন পরিয়ে জানাজা শেষে দাফন করেন। এভাবেই ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে দিন-রাত করোনায় আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ দাফন ও সৎকারে ছুটে চলেন তাঁরা।
গাউসিয়া কমিটির করোনা রোগী সেবা ও কাফন-দাফন স্বেচ্ছাসেবক কমিটির প্রধান সমন্বয়ক মোছাহেব উদ্দিন বখতেয়ার নিরাপদ নিউজকে বলেন, যে স্বেচ্ছাসেবকেরা লাশ সৎকারের কাজ করছেন, তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা যেহেতু বাড়ি ফিরতে পারছে না, তাই তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি। যতদিন এই মহামারী শেষ না হবে ততদিন পর্যন্ত সামর্থ্য অনুযায়ী অসহায় মানুষের সহযোগিতায় আমরা থাকব।
মোছাহেব উদ্দিন বখতেয়ার সবাইকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, করোনা ভাইরাসে কেউ মারা গেলে তাঁর স্বজনেরা যাতে ভয় না পান। তাঁর শেষবিদায়টা নিয়ম মেনে করেন। লাশের পাশে থাকেন। আসুন, মৃত ব্যক্তিদের সম্মান দিই। আতঙ্কিত না হই। করোনা ভাইরাসে যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁরা তো আমাদেরই কেউ। শেষবিদায়টুকু সম্মানের হোক।
চট্টগ্রাম নগরের আর বি কনভেনশন সেন্টারের কর্ণধার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ নিজ উদ্যোগী হয়ে স্বেচ্ছাসেবক টিমে কাজ করছেন। অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে নিরাপদ নিউজকে তিনি বললেন, এক দিন তিনটি লাশের সৎকার করতে বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সময় লাগে। মেডিকেলের মর্গের ভেতরের যে অবস্থা, তা তো অবর্ণনীয়। এক মৃত ব্যক্তির ছেলে হাসপাতালে এলেও, জানাজায় অংশ নিতে চাননি। আরেক মৃত ব্যক্তির ছোট ভাই জানিয়ে দেন, তিনি কোনো অবস্থাতেই হাসপাতালে আসবেন না। কয়েকটি ঘটনায় কোনো স্বজনকেই পাওয়া যায়নি। মৃত ব্যক্তির হাসপাতালের কাগজপত্র তৈরি না থাকলে পিপিইসহ অন্যান্য পোশাক পরে বসে থাকার সময় আরও বাড়তে থাকে। মৃত ব্যক্তিকে কবরে নামিয়ে দিয়ে টিমের সবার পিপিইসহ অন্যান্য সুরক্ষা পোশাক আগুনে পুড়িয়ে দিয়েই পরে ঘরে ফেরা সম্ভব হয়। তবে আমিসহ অন্য স্বেচ্ছাসেবকরা পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে নিজের বাড়িতে যাচ্ছেন না, থাকছেন সংস্থার নির্ধারণ করা জায়গায়।

গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশের দাফন সহায়তায় দায়িত্ব পালন করা স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ হোসেন খোকন ধনাঢ্য হোটেল ব্যবসায়ী, কিন্তু মানবিকতার টানে হাত গুটিয়ে বসে না থেকে তিনি এগিয়ে আসেন মানবিক কাজে। তিনি নিরাপদ নিউজকে বলেন, লাশের গোসল থেকে শুরু করে দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যখন ঘরে ফিরি, তখন নিজেরাই বুঝতে পারি না জীবিত আছি কি না। সুরক্ষা পোশাক পিপিই, হাতে গ্লাভস, চোখে চশমাসহ পুরো পোশাক পরে গরমের মধ্যে কাজ করা যে কতটা কষ্টসাধ্য, তা বলে বোঝানো যাবে না। দমবন্ধ হয়ে আসে একেক সময়। হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে কবরস্থানে কবর দেওয়া পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় মৃত ব্যক্তিদের স্বজনরাও কাছে আসেন না ভয় পেয়ে। তবে আমরা ভয় পাই না। এই মৃত ব্যক্তিরা তো আমাদেরই কারও না কারও স্বজন।
মারা যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত বিকাশ বড়ুয়ার ছেলে তমাল বড়ুয়া নিরাপদ নিউজকে বলেন, তাঁর বাবার লাশ গোসল ও শেষকৃত্যের সব কাজ করেন গাউসিয়া কমিটির স্বেচ্ছাসেবীরা। তাঁদের এই সহযোগিতা তাঁর কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

সাবস্ক্রাইব
Notify of
guest
0 মন্তব্য
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন