English

39 C
Dhaka
সোমবার, এপ্রিল ২৯, ২০২৪
- Advertisement -

উত্তরা দুর্ঘটনার দায় শুধু ঠিকাদারের?

- Advertisements -

মো. সামছুল হক: রাজধানীতে বাস্তবায়নাধীন বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার ধসে প্রাইভেটকারের ওপর পড়ে উত্তরায় পাঁচজন নিহত হওয়ার দুঃখজনক ঘটনা আমাদের অবহেলা, অনিয়ম ও দায়িত্বহীনতার নজির। যে বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণকাজের সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে, তার ঠিকাদার আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ কাজের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান দূরে থাক; নিরাপত্তা ব্যবস্থার কিছুই মানা হয়নি।

আমরা জানি, জনবহুল এলাকায় যে কোনো উন্নয়নমূলক কাজে ঝুঁকির মাত্রা বেশি থাকে বলে সতর্কতাও বেশি গ্রহণ করা হয়। দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সে জন্য যেমন প্রয়োজনীয় সতর্কতা গ্রহণ করা হয়, তেমনি দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কী করতে হবে; কীভাবে ক্ষতি কমানো যায়, তারও প্রস্তুতি থাকে। অথচ গার্ডারধসের ঘটনায় এর কোনোটিই ছিল না। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার, এ দুর্ঘটনার পরপরই ক্রেন অপারেটরসহ সেখানকার দায়িত্বরতরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় অবহেলা শুধু ঠিকাদারেরই নয়, বরং প্রকল্পটির পরামর্শক থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল পর্যায়ের সবারই দায় রয়েছে। সোমবারের অঘটনের আগে একই প্রকল্পে প্রায় একই ধরনের অন্তত তিনটি দুর্ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষের এতটুকু টনক নড়ল না!

প্রাথমিক তদন্তে ঠিকাদারের দায় পাওয়া গেছে বলে কর্তৃপক্ষ বলছে। বলা হচ্ছে, চুক্তি বাতিল করে চীনা ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করা হতে পারে। কিন্তু এ দায় শুধু ঠিকাদারের ওপর চাপানো হচ্ছে কেন? দুর্ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটি নিয়েই তো প্রশ্ন রয়েছে। তৃতীয় পক্ষের সংশ্নিষ্টতা ছাড়া এবং উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের না নিয়ে কীভাবে নিরপেক্ষ তদন্ত হতে পারে! যদিও যে কোনো অঘটনেই আমরা যেসব তদন্ত কমিটি গঠন করতে দেখি, সবটির অবস্থা তথৈবচ। অনেক ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনই প্রকাশ হয় না। অনেক সময় তদন্ত কমিটি সময় ক্ষেপণ করে ঘটনা লোকচক্ষুর আড়াল করতে চায়। গোড়ায় গলদ নিয়ে গঠিত উত্তরা দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটির ক্ষেত্রে কি এর ব্যতিক্রম হবে? তারপরও চাই, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসুক।

একা শুধু ঠিকাদারের দোষ; অন্যদের কোনো দায় নেই- এমনটি যদি হয়; তবে তদন্তের ফল হবে দুর্ভাগ্যজনক। ঠিকাদার প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু প্রকল্পের কাজ যথাযথ হচ্ছে কিনা, তা তদারকির দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের কী হবে? প্রকল্পের পরামর্শকদের দায়িত্ব তাহলে কী? ঠিকাদার যদি একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটিয়েও তার বিল তুলতে পারে তাহলে বুঝতে হবে, ভেতরে কোনো গলদ রয়েছে অথবা প্রকল্পসংশ্নিষ্টরা কোনো দায়িত্বই পালন করছেন না। প্রকল্পের দায়িত্বশীলদের তত্ত্বাবধানে অবহেলার কারণেই ঠিকাদার পার পেয়ে যায়।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের ব্যস্ততম সড়কে যানজটের দুর্ভোগ নিরসনে নেওয়া বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি প্রকল্পটি ২০১২ সালে নেওয়া হলেও এর ব্যয় আড়াই গুণ এবং সময় তিন দফা বাড়িয়েও কাজ শেষ হয়নি। বলা হচ্ছে, অর্থ সংকটে ঠিকাদার কাজ করতে পারছে না। ঠিকাদার যে কাজ করতে পারছে না- তাতে ব্যর্থতা কার? প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সরকারি সংস্থা এখানে কী করছে? দেশের অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের একই দশা। এখানেও কি ঠিকাদারের ব্যর্থতা?

বিআরটি প্রকল্পে কাজ করছে চীনের জিয়াংশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড এবং এ প্রকল্পের উড়াল অংশে কাজ করছে চায়না গেঝুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড। চীনারা তাদের দেশে উন্নয়ন ঘটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা জাপানের মতো উন্নত দেশেও তারা কাজ করছে। আমেরিকা-জাপানে যখন তারা কাজ করে, তার মানে- তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা কিংবা সামর্থ্যের ঘাটতি নেই। ওইসব দেশের কাজ সময়মতোই হয়ে যায়। কেন হয়? কারণ তারা কাজ আদায় করতে জানে। ঠিকাদারদের কাজ তারা সব সময় তত্ত্বাবধান করে। কোনো অনিয়ম ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই।

আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রকল্প তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে যারা থাকে তারা ঠিকাদারদের কাছ থেকে কাজ আদায় করতে পারে না। তাদের ছাই দিয়ে ধরতে পারে না। এ ক্ষেত্রে যেমন যোগ্যতা-দক্ষতার অভাব রয়েছে, তেমনি সদিচ্ছার অভাবও কম নয়। আমাদের যে মেট্রোরেলের কাজ এখনও চলছে; ইন্দোনেশিয়ায় একই সময়ে মেট্রোরেলের কাজ শুরু করে ইতোমধ্যে তা অপারেশনে চলে গেছে। আমরা কেন পারছি না?
বড় অবকাঠামোগত কাজে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। দুর্ঘটনা দৈব ঘটা অস্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক হলো তার প্রস্তুতি না থাকা। দুর্ঘটনা রোধ এবং দুর্ঘটনা ঘটার পরের প্রস্তুতি উভয়ই জরুরি। প্রি-ডিজাস্টার প্রিপেয়ার্ডনেস এবং পোস্ট-ডিজাস্টার প্ল্যানিং অর্থাৎ দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার দুই ধাপেই যথাযথ আয়োজন না থাকলে হতাহতের সংখ্যা বাড়াই স্বাভাবিক। দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধারে ক্রেন কিংবা আহতদের নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সও থাকার কথা। অথচ তা ছিল না। গার্ডার যে প্রাইভেটকারের ওপর পড়েছে, সেখানে নিহত পাঁচজনের সবাই সুস্থ ছিলেন। দুর্ঘটনায় যাঁরা পড়েন, তাঁরা তো অসুস্থ নন। তাৎক্ষণিক উদ্ধারের আয়োজন থাকলে হতাহতের সংখ্যা অনেক কমে যায়।

দুর্ঘটনা যাতে কম হয় সে জন্য উন্মুক্ত স্থানে ভারী অবকাঠামোগত কাজ সাধারণত রাতের বেলায় করা হয়। কেউ একজন বলছিলেন, সেখানে নাকি রাতে বেশি চাপ থাকে। হ্যাঁ, রাতের বেলায় ভারী যান চলাচল ওই সড়কে বেশি হতে পারে। কিন্তু দিনের বেলায় তো একদিকে ছোট ছোট যান থাকে; অন্যদিকে পথচারী। এদের সবাইকে সামলাতে হয়। আর দুর্ঘটনা ঘটে ছোট যানে এবং পথচারীদের ওপর। উত্তরা দুর্ঘটনায় তেমনটিই আমরা দেখেছি। দিনে সবারই তাড়া থাকে দ্রুত যাওয়ার। রাতের বিষয়টা এমন নয়। সেখানে ভারী যান, তা ছাড়া তাড়াহুড়োও নেই। প্রয়োজনে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে কাজ করা যায়। দিনে সেটা অনেক কঠিন।
উত্তরার কাজটি দিনে চলছিল এবং দুর্ঘটনা এড়াতে নিরাপত্তার জন্য নূ্যনতম ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি। ক্রেনের মাধ্যমে ৪০-৪৫ টন ওজনের গার্ডার ওঠানো হচ্ছে, অথচ নিচ দিয়ে দিব্যি মানুষ যাচ্ছে, গাড়ি চলছে! পুরো এলাকা নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে রাখা জরুরি ছিল। সে কাজটিও করা হলো না। এমনকি গার্ডারটি পড়ার পর পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করতে তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগল! গার্ডার পড়ার পর প্রাইভেটকারে থাকা একটি শিশুর কান্না দীর্ঘক্ষণ শোনা গেলেও তাকে জীবিত উদ্ধার করা যায়নি। এমন মর্মন্তুদ অঘটনের পরও কি আমাদের দায়িত্বশীলদের হুঁশ হবে না?

ড. মো. সামছুল হক: অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

সাবস্ক্রাইব
Notify of
guest
0 মন্তব্য
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন